স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উদ্যোক্তাদের বাজার সুবিধানির্ভর প্রতিযোগিতা থেকে সরে এসে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও দক্ষতানির্ভর প্রতিযোগিতায় মনোযোগ দিতে হবে। প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি করে দিতে হবে সরকারকে।
উত্তরণ-পরবর্তী আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে শুল্ক ও কোটামুক্ত বাজার সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ। যতটুকু সুবিধা হারাবে তার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নীতিগত সহায়তা দিতে হবে।
প্রস্তুতিপর্বে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে পরিকল্পনা নিতে হবে। প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে।
সক্ষমতা বাড়াতে হলে ব্যবসার সময় ও খরচ কমিয়ে আনা জরুরি। এর জন্য দেশে ব্যবসা শুরুর প্রক্রিয়া, নির্মাণ অনুমোদন, বিদ্যুৎ প্রাপ্তি, সম্পত্তি নিবন্ধন, ঋণপ্রাপ্তি, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর স্বার্থরক্ষা, কর পরিশোধ, সীমান্ত বাণিজ্য চুক্তি কার্যকর, দেউলিয়াত্ব মীমাংসা এবং আইনের সাংঘর্ষিক দিকগুলোর সংস্কার ও উন্নয়নের পাশাপাশি সড়ক, নৌ, সমুদ্র ও আকাশপথের যোগাযোগ নিরবচ্ছিন্ন করতে হবে। পাশাপাশি বন্দর ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, যানজট নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
সরকারের দেয়া এসব সুবিধা ভোগ করে উদ্যোক্তাদেরও উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর বিষয়ে তাগিদ থাকতে হবে। ব্যবসায় ই-কমার্স ও প্রযুক্তিনির্ভরতা বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি উদ্যোক্তা, ব্যবস্থাপনা, শ্রমিকসহ সবার দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে সমন্বয় করে কম সময়ে এবং কম খরচে বেশি পরিমাণ উৎপাদনের যোগ্যতা অর্জন করা।
পর্যাপ্ত বিনিয়োগ ছাড়া উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা কঠিন হবে। এ জন্য বিনিয়োগ বাড়াতেই হবে। এটি দেশে শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান, দক্ষতার উন্নয়ন, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও উৎপাদিত পণ্যের বৈচিত্র্য আনতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজার বেশ বড়। বিনিয়োগের সুযোগসুবিধা এবং জনগণের ক্রয়ক্ষমতা ও চাহিদা তুলনামূলক বেশি। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের আওতায় বেশি করে বিদেশি বিনিয়োগ আনার চেষ্টা করতে হবে।
এখানে উৎপাদিত পণ্য স্থানীয় চাহিদা পূরণ করতে পারলে অযাচিতভাবে বিদেশি পণ্য আমদানির প্রয়োজনীয়তা কমে আসবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে অতিরিক্ত পণ্য রপ্তানিও করা যাবে। তা ছাড়া বিদেশি পুঁজি ও শ্রমের উৎপাদনশীলতা বেশি। এর মাধ্যমে দেশে উদ্যোক্তা-শ্রমিকের মধ্যে দক্ষতা স্থানান্তরও সহজ হবে।
তবে এসব সুবিধা পেতে হলে অর্থনৈতিক অঞ্চলের অবকাঠামো বাস্তবায়নে সরকারকে জোরদার পদক্ষেপ নিতে হবে। যত দ্রুত এগুলোর কাজ শেষ করা যাবে, বিদেশি বিনিয়োগ তত দ্রুত আকৃষ্ট করা সম্ভব হবে।
উত্তরণজনিত কারণে বাজারসুবিধা হারানোর পাশাপাশি ওষুধ খাতে মেধাস্বত্ব সুবিধাও থাকবে না। এর ফলে সম্ভাব্য বিপর্যয় প্রতিরোধে এ-সংক্রান্ত আইন ও বিধিবিধান সংস্কার ও পরিবর্তন দরকার। পাশাপাশি দেশি-বিদেশি কোম্পানির উৎপাদনের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ মার্কেটে ওষুধের সরবরাহ বাড়িয়ে দাম সহনীয় রাখার কৌশল থাকতে হবে।
আন্তর্জাতিক বাজারে তৈরি পোশাকের প্রবেশে ট্যারিফ মূল্য বেশি। প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজারে টিকে থাকতে হলে এ খাতে সরকারের নীতি সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে। তবে রপ্তানি পণ্যের পরিধি বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
এ ক্ষেত্রে রপ্তানিযোগ্য এমন পণ্য খুঁজতে হবে, যার বৈশ্বিক চাহিদা বেশি হলেও সরবরাহ কম; ট্যারিফ মূল্যও কম। এ ধরনের পণ্য বেশি উৎপাদন ও বাড়তি মূল্য সংযোজন করতে পারলে বাজার সুবিধাজনিত রপ্তানির ক্ষতিও কমে আসবে।
শিল্পায়ন ও উৎপাদন প্রক্রিয়ায় উদ্যোক্তাদের উপযুক্ত পরিবেশের (কমপ্লায়েন্সের) দিকে বাড়তি নজর দেয়ার সময় এসেছে। উত্তরণের কারণে আন্তর্জাতিক ক্রেতা-ভোক্তা এবং প্রতিযোগীদের কঠোর দৃষ্টি থাকবে রপ্তানিকৃত পণ্যের অরিজিনের ওপর।
সেখানে বিবেচনায় আসবে উৎপাদকের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, শ্রমের ন্যায্যতা, কাজের সহায়ক পরিবেশসহ নানা দিক। কোনো একটি ক্ষেত্রে কেউ অসন্তুষ্ট হলে ঘনঘন আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার প্রবণতা বাড়বে। কমপ্লায়েন্স ক্যাটাগরি ঠিক থাকলে এ সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার প্রয়োজন হবে না। উলটো পণ্যের ন্যায্য দামও নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।
এ-সংক্রান্ত সম্ভাব্য ঝামেলা এড়াতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় চুক্তি এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে উদ্যোক্তার সমঝোতা চুক্তি করতে হবে। তবে এ বিষয়ে আলোচনার জন্য দর কষাকষির সুযোগ থাকতে হবে।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান: সিপিডির সম্মানীয় ফেলো
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শাহ আলম খান